
মুক্তি আকা খাতুন (মাহি)
জীবনের প্রতিকূল ঢেউয়ে ভেসে গিয়েও যারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় গড়ে তোলেন নিজেদের ভাগ্য, মুক্তি আকা খাতুন (মাহি) তাদের অন্যতম। রংপুর বিভাগে “অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী” ক্যাটাগরিতে “জয়িতা” সম্মানে ভূষিত এই সংগ্রামী নারী শুধু নিজেকে গড়ে তোলেননি, বরং হয়েছেন অনেকের অনুপ্রেরণা। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে পর্যটন ও বিমান টিকেটিং খাতে তার অসামান্য সাফল্য প্রমাণ করে—সাহস ও পরিশ্রম থাকলে নারীর জন্য কোনো ক্ষেত্রই দূরহ নয়।সৈয়দপুরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মাহি ছিলেন নয় ভাইবোনের একজন। বাবার আকস্মিক মৃত্যু তাদের সংসারে আনে চরম সংকট, তখন তিনি উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি সংকল্প করেন, এই দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসবেন।২০০৯ সালে টিএমএসএস-এর সিএনপি পদে মা ও শিশুর পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করে তার কর্মজীবনের সূচনা। ২০১২ সালে মাত্র ছয় হাজার টাকা বেতনে গালিব ইন্টারন্যাশনালে বিমানের টিকিট বিক্রেতা হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি টিউশন ও কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।২০১৬ সালে মারিয়া এভিয়েশনে যোগ দিয়ে বিমানের টিকেটিং খাতে আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সৈয়দপুর বিমানবন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস বাংলা, নভোএয়ারসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে কাজ করে তার পেশাগত দক্ষতা আরও শাণিত হয়। এই সময়েই তিনি উপলব্ধি করেন, নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর মাহি প্রতিষ্ঠা করেন “গাউসিয়া ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস”। একসময় যেখানে তিনি ছিলেন একজন কর্মী, সেখানেই তিনি হয়ে ওঠেন একজন সফল উদ্যোক্তা। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে ১০ জন কর্মী কাজ করছেন, যারা তার মতোই নতুন দিগন্তের সন্ধান পেয়েছেন।তিনি ৯ই ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া দিবস-২০১৭ উদযাপন উপলক্ষে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সমগ্র দেশব্যাপী পরিচালিত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশেষ কার্যক্রমের আওতায় ‘অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী’ ক্যাটাগরিতে সৈয়দপুর উপজেলা ও নীলফামারী জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হন।এই স্বীকৃতি তার শ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রতিচ্ছবি, যা বহু নারীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।এছাড়া ৮ ডিসেম্বর ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও নতুন উদ্যোক্তা তৈরীর জন্য Skills for Employment Investment Program (SEIP) Project Tranche-3 এর আওতায় SME & Special Programmers Department বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড-এর সহযোগিতায় “Entrepreneurship Development Program” প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে আগত প্রায় ১৫০টি আবেদন যাচাই-বাছাই করে ৪৫ জন উদ্যোক্তাকে Selection এর জন্য শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর ট্রেনিং একাডেমীতে সাক্ষাতের জন্যে ডাকা হয়। Selection কমিটির যাচাই-বাছাই ও সরাসরি ইন্টারভিউতে ২৫ জন উদ্যোক্তাকে নির্বাচন করা হয়। উক্ত ২৫ জন সৌভাগ্যবান উদ্যোক্তাদের মধ্যে মুক্তি আকা খাতুন মাহি (জয়িতা নারী) একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে মাসব্যাপী “উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ” কোর্সে অংশ গ্রহণের জন্যে নির্বাচিত হন এবং সাফল্যের সাথে তা সম্পূর্ণ করেন।মাহি শুধু একজন সফল ব্যবসায়ী নন, তিনি তার পরিবারের জন্যও এক আলোকবর্তিকা। বাবার অনুপস্থিতিতে ভাইবোনদের শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, তাদের স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করেন। তার ভাইবোনেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, যা মাহির আত্মত্যাগ ও অনুপ্রেরণার ফলাফল।প্রজুপ্ক্তিগত দক্ষতার গুরুত্ব অনুধাবন করে মাহি ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “গাউসিয়া ওমেন্স কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার”। তার লক্ষ্য, নারীদের দক্ষতা বাড়িয়ে আত্মনির্ভরশীল করা। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ৭ মার্চ সৈয়দপুরে সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হৃদয়ে সৈয়দপুর তাঁকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে “নারী সম্মাননা-২০২৫” এর ৮ টি ক্যাটাগরির মধ্যে “সেরা নারী উদ্যোক্তা” প্রথম ক্যাটাগরিতে মুক্তি আকা খাতুন মাহি (জয়িতা নারী) কে নির্বাচিত করে।মাহির জীবন আমাদের শেখায়—পরিস্থিতি যত কঠিনই হোক, সংকল্প ও পরিশ্রম মানুষকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যেতে পারে। তিনি নারীদের উদ্দেশে বলতে চান, “নিজেকে কখনও তুচ্ছ মনে কোরো না, স্বপ্ন দেখো, লড়াই করো, জয় তোমার হবেই।”তার জীবনসংগ্রাম শুধু একটি গল্প নয়, এটি এক অনুপ্রেরণা, যা নারীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে এবং দেখিয়ে দেবে—নারীর শক্তি সীমাহীন।